১৬. হযরত ইউশা বিন নুন আঃ এর পরিচয় ও বিশেষ ঘটনা

পরিচয়ঃ তিনি ছিলেন হযরত মুসা (আ)-এর কাজের লোক। মুসা নবী যখন হযরত খিযির (আ)-এর সাথে দেখা করতে যান, তখন তাঁর সাথে ছিলেন একজন পরিচর্যাকারী বা খাদিম, অন্য অর্থে ভৃত্য। এই খাদিম ব্যক্তিটিই ছিলেন হযরত ইউশা বিন নুন – যাকে ইসলামে নবী’র সম্মান দেওয়া হয়েছে। হযরত মুসা’র পরে ইউশা ইবনে নুনই বনী ইসরাইলীদের রাজা হোন। তিনি ইসরাইলী গোত্রকে নেতৃত্ব দিয়ে পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস জয় করেন। হযরত ইউশা’র কাছেই ছিলো মুসা নবী’র কাপড় এবং ট্যাবলেট। আজ আমরা বাড়ির ভৃত্যদের সাথে কি সব ব্যবহার করি। অথচ, কোরআন আমাদের অন্য কিছু শিক্ষা দেয় যা আমরা ভুলে গিয়েছি।

বংশ: হযরত ইউশা বিন নূন ( আঃ ) বনী ইসরাঈল বংশোদ্ভূত । ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁকে হযরত ইউসুফ (আঃ) -এর গোত্রের লোক বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন । তাঁর পিতার নাম নূন এবং পিতামহের নাম ফারাহীম । আর ফারাহীম হযরত ইউসুফ (আঃ) -এর পুত্র । নবুয়ত লাভ ফেরআউনের সদলবলে লোহিত সাগরে নিমজ্জিত হবার পর আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা (আঃ) -কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আরদে মোকাদ্দাসা- পবিত্র ভূমির উপর বনী ইসরাঈলকে কর্তৃত্ব প্রদান করবেন ।

বাসস্থানঃ মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলদের সহ যখন মিসরত্যাগে আদিষ্ট হয়েছিলেন , তখন তাঁকে বলা হয়েছিল সিরিয়ার একটি এলাকা কেনানে উপনীত হওয়ার জন্য। কেননা , কেনানই বনী ইসরাঈলের আদি আবাসভূমি । বনী ইসরাঈলের ঊর্ধ্বতন পুরুষ হযরত ইয়াকুব (আঃ) কেনান থেকেই মিসরে গমন করেছিলেন । 

আল্লাহ তাআলা হযরত মূসা ( আঃ ) -এর সাথে যে পবিত্র ভূমির কর্তৃত্ব প্রদানের ওয়াদা করেছিলেন , তা সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল। আর কেনান যেহেতু বৃহত্তর সিরিয়ারই একটি এলাকার নাম- তাই কেনানও পবিত্র ভূমিরই অংশবিশেষ। মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলকে নিয়ে সিরিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন এবং আরিখা নামক স্থানে উপনীত হয়ে শিবির স্থাপন করেন । 

আরিখায় যাত্রাবিরতি করে মূসা (আঃ) বনী ইসরাঈলের বার গোত্রের বার জন প্রধান ব্যক্তি সমন্বয়ে একটি প্রতিনিধি দল কেনানে প্রেরণ করেন। কারণ, তখন কেনানসহ সমগ্র সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল- যা পবিত্র ভূমি বলে খ্যাত, তার সবটুকুই এক দুর্ধর্ষ পরাক্রান্ত সম্প্রদায় কবলিত ছিল। এ সম্প্রদায়ের নাম ইতিহাসে আমালেকা বলে উক্ত হয়েছে। যে প্রতিনিধি দল প্রেরিত হয়েছিল, তাতে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) ও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন । 

প্রতিনিধি দল কেনানে পাঠানোর উদ্দেশ্য ছিল, তারা কেনানের অভ্যন্তরে প্রবেশপুর্বক সরেজমিনে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এসে হযরত মূসা (আঃ) -কে অবহিত করবেন। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের প্রতি নির্দেশ ছিল, তারা যেন দ্রষ্টব্য স্থানের কোন তথ্য মূসা (আঃ) ব্যতিরেকে বনী ইসরাঈলের সর্বসাধারণের নিকট প্রকাশ না করেন, কিন্তু মাত্র দুই জনই এই নির্দেশ যথাযথভাবে পালন করেন। 

এদের একজন ইউশা বিন নূন। অবশিষ্ট দশ জনই হযরত মূসা (আঃ) প্রদত্ত আদেশ অমান্য করে সর্বসাধারণের নিকট গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেয়। ফলে মূসা (আঃ) যে শংকা থেকে পূর্বাহ্ণে প্রতিনিধি দল। প্রেরণের কার্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তাই বাস্তব হয়ে দেখা দেয়। 

সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হতেই হযরত মূসা (আঃ) আশংকাবোধ করছিলেন যে, কেনানসহ সমগ্র সিরিয়া ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলই প্রবল পরাক্রান্ত দুর্ধর্ষ আমালেকা সম্প্রদায়ের কবলে। সুতরাং আমালেকা সম্প্রদায়ের দৈহিক শক্তিমত্তা, প্রকান্ড দেহাবয়ব, যুদ্ধ কৌশল ইত্যাদি সম্পর্কে জেনে ফেললে বক্র, ভীতু, সন্দেহপ্রবণ, নিজের উপর আস্থাহীন বনী ইসরাঈল সম্প্রদায় কিছুতেই আমালেকা সম্প্রদায়ের সাথে সম্মুখ জেহাদে অবতরণে সম্মত হবে না। 

প্রতিনিধি দলের দশ সদস্য কর্তৃক হযরত মূসা (আঃ) -এর আদেশ লংঘিত হয়ে তাঁর আশংকাই বাস্তব হয়ে প্রকাশ পায়। বনী ইসরাঈলকে আমালেকা সম্প্রদায়ের সাথে জেহাদে অবতরণের আহ্বান জানানো হলে তারা সে আহ্বান সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের সাফ জবাব- প্রবল পরাক্রান্ত আমালেকা সম্প্রদায়ের সাথে সম্মুখ জেহাদে অবতরণ আমাদের দ্বারা হবে না। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত তথা হতে বের না হবে , ততক্ষণ আমরা সেখানে প্রবেশ করব না। 

তারা মূসা (আঃ) -কে রূঢ় ভাষায় জানিয়ে দিল- আপনি এবং আপনার প্রভু গিয়ে জেহাদ করুন। আমরা তো যেখানে আছি সেখানেই অবস্থান করব। হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) বনী ইসরাঈলকে বহুভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, তোমাদের কোন প্রকার জেহাদ যুদ্ধ করতে হবে না। তোমরা শুধু আল্লাহ কর্তৃক তাঁর রাসূল মূসা (আঃ) -কে প্রদত্ত অঙ্গীকারের উপর পরিপূর্ণ আস্থা বিশ্বাস রেখে কেনানে প্রবেশ কর। তা হলেই আল্লাহ তাআলা প্রবল পরাক্রান্ত, মহাশক্তিধর আমালেকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তোমাদেরকে বিজয় দান করবেন। কেনানসহ সমগ্র পবিত্র ভূমি এলাকা তোমাদের করতলগত হবে। 

কিন্তু তারা আল্লাহর অঙ্গীকার, আল্লাহর রাসূল মূসা (আঃ) -ও রাসূলের প্রতিনিধি হযরত ইউশা বিন নুন (আঃ) -এর পুনঃ পুনঃ বুঝানো সত্ত্বেও নিজেদের হঠকারিতার উপরই স্থিত থাকে। ফলে আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হয়ে হঠকারী বনী ইসরাঈলকে তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর বন্দী জীবন কাটানোর শাস্তি প্রদান করেন। তীহ প্রান্তরে বনী ইসরাঈলী বন্দীদের সাথে হযরত মূসা (আ), হযরত হারুন (আঃ) এবং হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) ও অবস্থান করতে থাকেন দুর্ভাগা বনী ইসরাঈলের দেখাশোনা ও তত্ত্বাবধানের উদ্দেশে। 

হযরত মূসা (আঃ) যখন হযরত খিযির (আঃ) -এর সাক্ষাত লাভের উদ্দেশে সফর করেন , তখন হযরত ইউশা বিন নূন (আ) তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন । ইউশা বিন নূন (আঃ) -কে মূসা (আঃ) -এর ইনতেকালের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

বিশেষ ঘটনাঃ মূসা (আঃ) -এর ইনতেকালের পর বনী ইসরাঈল তীহ প্রান্তরের চল্লিশ বছরের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি লাভ করে। তখন হযরত ইউশা বিন নূন (আ) -কে নির্দেশ দেয়া হল, যেন আমালেকা সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ করে কেনান দখল করে নেন। বনী ইসরাঈল সার্বিক প্রস্তুতি সহকারে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ)-এর অনুগমন করে। তাওরাতে বর্ণিত হয়েছে , বনী ইসরাঈল সৈন্য হিসাবে হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) -এর অনুগমনকালে আল্লাহ তাআলার প্রতিশ্রুতির বাহক সিন্দুকটিও তাদের সাথে ছিল।

এ সিন্দুকটি যাদের সাথে থাকবে , আল্লাহ তাআলা তাদেরকে বিজয়ের সম্মানে ভূষিত করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। হযরত মূসা (আঃ) লোহিত সাগর অতিক্রমকালে এ সিন্দুক তাঁর সাথে ছিল । তদুপরি বনী ইসরাঈলী বাহিনীর সাথে হযরত মূসা (আ ) -এর লাঠি, হযরত হারুন (আঃ) -এর জামাকাপড়সহ অন্যান্য বরকতময় দ্রব্যও ছিল। হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) বনী ইসরাঈলী বাহিনীসহ বায়তুল মোকাদ্দাসে উপনীত হলে আমালেকা সম্প্রদায় এ সংবাদ অবগত হয় এবং সার্বিক যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। উভয় দল মুখোমুখি হলে দিনব্যাপী তুমুল যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যা সমাগতপ্রায়, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল কোন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করছে না। যদিও ময়দানে বনী ইসরাঈলী বাহিনী এগিয়ে রয়েছে। ঐ

দিন ছিল শুক্রবার। তাওরাত কিতাবে শনিবারে এবাদত ব্যতীত যুদ্ধবিগ্রহ এবং জাগতিক সর্বপ্রকার দিনটি কাজকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। সুতরাং আজকেই যদি একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হয় , তা হলে যুদ্ধ পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে মোড় নিতে পারে অথচ সন্ধ্যা সমাগতপ্রায় । সামান্য কিছু সময়ের জন্য চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে না। অদ্যকার সূর্যাস্তের পূর্বেই যুদ্ধের একটা চূড়ান্ত ফলাফল অর্জিত হওয়া দরকার। হযরত ইউশা বিন নূন (আঃ) আসমানের দিকে মুখ তুলে নিবেদন করলেন- ইয়া আল্লাহ! সূর্য আপনার আদেশক্রমেই পরিচালিত হচ্ছে। আমরাও আপনার আদেশেই জেহাদে অবতীর্ণ হয়েছি। সুতরাং আমরা বিজয়ী না হওয়া পর্যন্ত সূর্যের অস্তাগমন বিলম্বিত করুন। এ দোআ কবুল হয়। 

সূর্য অস্তমিত হওয়ার সময় একেবারে ঘনিয়ে এলেও অস্তমিত হয় নাই । অবশেষে বনী ইসরাঈল বাহিনী জেহাদে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। একদা হযরত ইউসুফ (আঃ) -এর বদৌলতে সত্তর জন কেনানী সসম্মানে মিসরে চিরস্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ লাভ করেছিল। আর আজ তাঁরই প্রপৌত্র ইউশা বিন নূন (আঃ) -এর নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ প্রবল পরাক্রান্ত আমালেকা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিজয় পতাকা উড্ডীনপূর্বক লাখ লাখ বনী ইসরাঈল নিজেদের আদি পিতৃভূমি কেনানে প্রবেশ করে। 

যুদ্ধে জয়লাভ করার পর হযরত ইউশা বিন নুন (আঃ) বনী ইসরাঈলকে বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশের আদেশ করেন। তাদেরকে বলা হয়েছিল- বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশকালে যেন তারা নিজেদের পূর্বকৃত অপরাধসমূহের জন্য আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু এক্ষেত্রে বনী ইসরাঈল নিজেদের স্বভাবগত বক্রতা আর হঠকারিতার পরিচয় দিতে বিস্তৃত হয় নাই। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল , তারা যেন বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশকালে হিত্তাতুন- তওবা বলতে বলতে আল্লাহর দরবারে নিজেদের পূর্বকৃত গোনাহর ক্ষমা প্রার্থনারত অবস্থায় নতশিরে প্রবেশ করে । 

অথচ তারা আল্লাহর এ নির্দেশের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্বক শির উঠিয়ে হিনতাতুন- গম গম বলে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করতে করতে বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশ করে। বায়তুল মোকাদ্দাস প্রবেশকালে বনী ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহর নির্দেশ এবং তৎপ্রতি তাদের অবজ্ঞা উপেক্ষার ঘটনা কোরআন করীমে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন।

আর যখন আমি তাদেরকে বললাম, এই জনপদে প্রবেশ কর, অতঃপর তোমাদের যেখান থেকে ইচ্ছা হয় খাও, আর যখন প্রবেশ করবে, নতশিরে তওবা বলতে থাক, তাহলে আমি তোমাদের গোনাসমূহ ক্ষমা করে দেব; আর আন্তরিকতার সাথে নেক আমলকারীকে আমি সত্বরই অধিক দান করব। অনন্তর জালেমরা সে কথা অন্য কথা দ্বারা পরিবর্তন করে দিল, অতএব আমি তাদের প্রতি আসমান হতে আযাব অবতরণ করলাম, কেননা তারা হুকুম অমান্য করছিল। – ( সূরা বাকারা ২ , আয়াত ৫৮-৫৯ ) – হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, বায়তুল মোকাদ্দাসে প্রবেশের রীতি সম্বলিত আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা এবং তৎপ্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করার অপরাধে বনী ইসরাঈল প্লেগ মহামারীতে আক্রান্ত হয় এবং স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সত্তর হাজার বনী ইসরাঈলী কালকবলে পতিত হয়।

মৃত্যুঃ অতঃপর বাইতুল মাক্কাদাসকে রাজধানী করে ফিলিস্তেনের অধিবাসীদেরকে হযরত ইউশা আল্লাহর কিতাব তাওরাত অনুসারে ২৭ বছর শাসন করেন। তিনি ১২৭ বছর বয়সে ইন্তিকাল করেন বলে বর্ণিত আছে।


ইসলামিক কুইজ: লেভেল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ৫০০ টি প্রশ্নের ইসলামিক কুইজ আয়োজন করেছি। এই কুইজে অংশগ্রহণ করে দেখে নিতে পারেন ইসলামের ব্যাপারে আপনার জ্ঞান কতটা। ইসলামিক কুইজে অংশগ্রহণ করতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি আপনি দেখতে পারেন। এখানে ইসলামিক এবং সমসাময়িক বিশ্বের বিভিন্ন কিছুর ব্যাপারে অনেক ভিডিও পেয়ে থাকবেন। আশা করি ভিডিওগুলো আপনাদের ভাল লাগবে। এখানে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top