আমরা সকলে এটা জানি আল্লাহ সুদকে হারাম করেছেন, কিন্তু অনেক মুসলিমরা এটা জানে না যে, আল্লাহ কেন সুদকে হারাম করেছেন? সুদের কারনে কি ক্ষতি হয়? এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়লে আশা করা যায় আপনি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন ইনশাআল্লাহ।
সূরা আল-বাকারা: ২৭৮,২৭৯
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সুদের যা অবশিষ্ট আছে, তা পরিত্যাগ কর, যদি তোমরা মুমিন হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না কর তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা নাও,…….
সুদের কারণে কি ক্ষতি হয়
সুদের কারণে সমাজে এবং রাষ্ট্রে এবং মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে অগণিত সমস্যার সৃষ্টি হয়। যারা অর্থনীতির ব্যাপারে বিশেষ জ্ঞান রাখে, তারা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে যে সুদের কারণে সমাজে কি ক্ষতি হয়। কিন্তু সব মানুষের পক্ষে সুদের সমস্ত ক্ষতিগুলা বুঝতে পারাটা কিছুটা কঠিন। তাই আমি যেই সমস্যাগুলো সব মানুষ সহজে বুঝতে পারবে, তার মধ্য থেকে কয়েকটা সমস্যা ব্যাখ্যা করলাম।
- ১. সুদ দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যায়।
- ২. সুদ সাধারণ মানুষের টাকার সঞ্চয় করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
- ৩. সুদ ধনী-গরিব বৈষম্য সৃষ্টি করে।
- ৪. সুদের কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।
- ৫. সুদ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করার সুযোগ করে দেয়।
- ৬. সুদ পাবার কারনে ঋণের সিকিউরিটি প্রদানর মত সম্পদ যাদে আছে, তারা বেশি ঋণ পায়। যাদের প্রয়োজন তারা পায় না।
- ৭. সুদ বিদেশী দাতা দেশের স্বার্থ হাসিল করে।
- ৮. সুদ ঋণ-দাসত্ব প্রথার জন্ম দেয়।
সুদ কিভাবে ক্ষতি করে?
সুদ হচ্ছে পরের সম্পদ বিনামূল্যে খাওয়া, গ্রাস করা, আত্মসাৎ করা। চুরি, ডাকাতি, জুয়া, ঘুষ-দুর্নীতির চেয়েও মারাত্মক জুলুম ও শোষণ হচ্ছে সুদ। এসব অন্যায় ভক্ষণ জাতির ধ্বংস বয়ে আনবে এটাই স্বাভাবিক। আল্লাহ নিজের নাম নিয়ে নিজেই আল-কুরআনে বলেছেন, “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করেন” – ২: ২৭৬
১. সুদ দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে দেয়
ব্যবসায়ী ও উৎপাদন কারীগণ যখন সুদের বিনিময়ে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ, করে তখন তারা উক্ত সুদকে উৎপাদন খরচের সাথে যোগ করে।
- সুদমুক্ত অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়= মজুরী+ট্যাক্স+মুনাফা=দ্রব্যমূল্য।
- সুদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ব্যয়= মজুরী+ট্যাক্স+সুদ+মুনাফা=দ্রব্যমূল্য।
ফলে স্বাভাবিকভাবে সুদ মুক্ত অর্থনীতি অপেক্ষা সুদী অর্থনীতিতে দ্রব্যমূল্য বেশি হয়। নিম্নের উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করা যেতে পারে:
মনে করা যাক, একজন ব্যবসায়ী সাবান উৎপাদন করতে সুদমুক্ত অর্থনীতিতে মজুরী বাবদ ১০/টাকা, ট্যাক্স বাবদ ৫/টাকা এবং মুনাফা বাবদ ২/টাকা ব্যয় হয়। এক্ষেত্রে সাবানের মোট উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ১০+৫+২ =১৭.০০ টাকা মাত্র। সাবানটি বাজারে ১৭ টাকায় বিক্রি করা যায়।
কিন্তু সুদী অর্থনীতিতে যদি একই অবস্থা বিরাজ করে, তাহলে উক্ত ব্যয়ের সাথে ব্যবসায়ী কর্তৃক ঋণদাতাকে প্রদত্ত সুদ যুক্ত হবে। মনে করা যাক, একজন ব্যবসায়ী সাবান উৎপাদন করার জন্য ব্যাংক থেকে ২০% সুদে ১ লক্ষ টাকা ঋণ নিল। এর মানে হলো তাকে ২০ হাজার টাকা সুদ হিসেবে অতিরিক্ত ফেরত দিতে হবে। এই ব্যবসায়ী এই ২০ হাজার টাকা তার নিজের পকেট থেকে দিবে না। সে এই ২০ হাজার টাকা সাবান উৎপাদনের ব্যয়ের সাথে যুক্ত করবে। সে যদি ১০০০ সাবান উৎপাদন করে তাহলে প্রতি সাবানে তার সুদ বাবদ ২ টাকা করে যোগ করতে হবে। ব্যবসায়ীকে সাবান উৎপাদন করতে সুদী অর্থনীতিতে মজুরী বাবদ ১০/টাকা, ট্যাক্স বাবদ ৫/টাকা, সুদ বাবদ ২/টাকা এবং মুনাফা বাবদ ২/টাকা ব্যয় হয়। এই সুদ যোগ করে দ্রব্যটির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়াবে ১০+৫+২+২=১৯ টাকা। দ্রব্যটি ১৯ টাকার কমে বিক্রি করা হলে উদ্যেক্তার লাভ কমে যাবে অথবা তাকে লোকসান দিতে হবে। সুতরাং সুদমুক্ত অর্থনীতিতে যে পণ্যের দাম হচ্ছে ১৭ টাকা, সুদী অর্থনীতিতে তারই দাম দাঁড়াচ্ছে ১৯ টাকা।
“দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পিছনে সরকার, ব্যবসায়ী ঠিক যতটা দায়ী, সাধারণ মানুষ যারা সুদের সাথে লিপ্ত তারাও ঠিক ততটাই দায়ী। কারণ সাধারণ মানুষ যদি সুদি লেনদেন এর সাথে লিপ্ত না থাকতো তাইলে সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যেত”
২. সুদ মানুষের টাকার সঞ্চয় কমিয়ে দেয়
উপরের সাবান ব্যবসায়ীর উদাহরণটি যদি আপনি ভালোভাবে বুঝে থাকেন, তাহলে সুদ কিভাবে মানুষের টাকার সঞ্চয় কমিয়ে দেয় এটা বুঝতে আপনার অসুবিধা হবে না ইনশাআল্লাহ। তবে সুদ কিভাবে মানুষের সঞ্চয় কমিয়ে দেয় এটা বুঝার আগে, চলুন আমরা আগে এটা বুঝে নেই মানুষ কেন টাকা সঞ্চয় করে?
মানুষ অধিক সুদ পাবার জন্য সঞ্চয় করে না। বরং মানুষ সঞ্চয় করে ভবিষ্যতের চিন্তায়, অজানা বিপদ-আপদ মুকাবিলার জন্য, সন্তান-সন্ততির শিক্ষা বিয়ে-শাদী, ভবিষ্যতে নিজের ব্যবসা আরো বড় করার জন্য মূলধন হিসেবে ইত্যাদি কারণে। সুদ না থাকলেও এসব কারনে মানুষ সঞ্চয় করবেই। তাই নয় কি? অর্থনীতিবিদ প্যারেটো তাই বলেছেন, “সঞ্চয় সুদের হারের দ্বারা প্রভাবিত হয় না; বরং সুদের হারকে যদি শূন্যেও নামিয়ে আনা হয়, তাহলেও মানুষ সঞ্চয় করবেই।”
টাকা সঞ্চয় নির্ভর করে আয়ের ওপর। আয় বাড়লে মানুষ সঞ্চয় বেশি করে, আর আয় কমলে টাকা সঞ্চয় কম করে। সুদের হার বৃদ্ধি করার দরুন দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য বেড়ে যাবে। উপরের সাবান ব্যবসায়ীর উদাহরণটিতে আমরা সেটা স্পষ্ট দেখেছি। ফলে আগের সমান পণ্য-সামগ্রী ক্রয় করতে হলে লোকদেরকে পূর্বের চেয়ে বেশি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝা সহজ হবে। ধরা যাক, আপনার মোট আয় প্রতি মাসে ১০০/- টাকা। আরও মনে করা যাক যে,আপনি প্রতি মাসে ২০.০০ টাকা সঞ্চয় করেন এবং প্রতি মাসে বাজার করার জন্য ২৩ টাকার তেল + ১৭ টাকার সাবান + ২০ টাকার চাল + ২০ টাকার ডাল= মোট ৮০ টাকা ব্যয় করেন।
উপরের সাবান ব্যবসায়ীর উদাহরণটিতে আমরা দেখেছি, সুদের কারণে সাবানের দাম ২ টাকা বেড়ে গেল। ফলে পূর্বে ৮০/- টাকায় যে পরিমাণ পণ্য-সামগ্র্রী কেনা যেত এখন সেই পরিমাণ পণ-সামগ্রী ক্রয় করতে ২ টাকা বেশি লাগবে, কারণ সাবানের দাম ১৭ টাকা থেকে বেড়ে ১৯ টাকা হয়ে গেছে। অর্থাৎ এখন বাজার করতে মোট ৮২/- টাকা লাগবে। তাহলে আপনার সঞ্চয় ১৮ টাকায় দাঁড়াবে (মোট আয় ১০০ – ব্যয় ৮২ টাকা = সঞ্চয় ১৮ টাকায়) আগে আপনি সঞ্চয় করতেন ২০ টাকা, সুদ এর কারনে এখন সঞ্চয় করতে পারছেন ১৮ টাকা।
৩. সুদ ধনী-গরিব বৈষম্য সৃষ্টি করে
উপরের সাবান ব্যবসায়ীর উদাহরণটি যদি আপনি ভালোভাবে খেয়াল করেন, তাহলে সুদ কিভাবে ধনী-গরিব বৈষম্য সৃষ্টি করে, এটা বুঝতে আপনার অসুবিধা হবে না ইনশাআল্লাহ। সাবান ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ২০% সুদে ১ লক্ষ টাকা ঋণ নিল। এর মানে হলো তাকে ২০ হাজার টাকা সুদ হিসেবে অতিরিক্ত ফেরত দিতে হবে। তাই সাবান ব্যবসায়ী সাবান এর দাম ২ টাকা করে বারিয়ে ফেলল। আমার এবং আপনার মত হাজার হাজার সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ২ টাকা করে বেশি নিল। এই টাকাটা কিন্তু ব্যবসায়ী নিজের কাছে রাখতে পারবেনা। তাকে টাকাটা ব্যাংকে সুদ হিসাবে ফিরিয়ে দিতে হবে। এখন একটু চিন্তা করে দেখুন, হাজারো মানুষ যাদের এই সুদের সাথে কোন লেনাদেনাই ছিল না, তাদের টাকাও এই ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ধনীদের কাছে চলে যাচ্ছে। এই ভাবেই ধনীরা সুদের মাধ্যমে অনেক অনেক টাকা আয় করছে। আর গরিবরা দিন দিন গরীবই হচ্ছে।
এই সাবান ব্যবসায়ীর মত ৯০% ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে অথবা ধনীদের অথবা বিভিন্ন এনজিও থেকে সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা করে। আর সেই সুদের টাকা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে জিনিসের দাম বৃদ্ধি করে আদায় করে। তারপর সেটা চলে যায় আবার ধনীদের হাতে। আর এই খেলা দিনের পর দিন চলতেই থাকে, ধনীরা দিন দিন ধনী হয়, আর গরিবরা দিন দিন গরীব হয়।
সরকার উন্নয়নমূলক কাজ করার জন্য ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নেয়। যেমন ব্রিজ, স্কুল, হাসপাতাল, বানানোর জন্য ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নেয়। পরবর্তীতে সরকার ব্যাংকের এই সুদের টাকা পরিশোধ করার জন্য মানুষের কাছ থেকে উচ্চহারে কর/ট্যাক্স/খাজনা/ভ্যাট আদায় করে। এখানেও সাধারণ মানুষ জুলুমের শিকার হয়। আপনি হয়তো ভাবছেন, আপনি তো সরকারকে ইনকাম ট্যাক্স দেন না। কিন্তু আপনি বাজার থেকে যেই কোন পণ্য কিনেনা কেন, প্রতিটা পণ্যের সাথে সরকার ভ্যাট যুক্ত করে আর এই ভ্যাট যুক্ত করার মাধ্যমে জিনিস এর দাম বৃদ্ধি পায়। আর সেই টাকা দিয়ে সরকার ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করে। আপনার আমার কষ্টের টাকা এভাবেই চলে যায় সুদখোর ধনীদের হাতে। তাই সুদ একটি সামাজিক জুলুম।
৪. সুদের কারণে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়।
বেকারত্ব বৃদ্ধির জন্য যে কয়টি কারণ দায়ী তার মধ্যে সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা অন্যতম। সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থার কারণে মানুষের কর্মসংস্থানের অভাব হচ্ছে এবং নতুন নতুন মানুষ চাকুরী হারিয়ে বেকারত্বের শিকার হচ্ছে।
সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থায় বিনা সুদে ঋণ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকে না। ঋণ নেয়ার ১ মাস পর থেকেই তাকে ঋণের টাকা পরিশোধ করা শুরু করতে হয়। প্রতিমাসেই তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা কিস্তি হিসাবে ফেরত দিতে হয়। একজন ব্যবসায়ী একটা ব্যবসা শুরু করার পরের মাস থেকেই তার কোন টাকা ইনকাম শুরু নাও হতে পারে। একটা ব্যবসা শুরুর প্রথম ৬ মাস থেকে ১ বছর পর্যন্ত ব্যবসা থেকে তেমন কোন আয় হয় না। কিন্তু সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিলে ১ মাস পর থেকেই তাকে ঋণের টাকা পরিশোধ করার জন্য বাধ্য করা হয়। এই পরিস্থিতিতে কোন ব্যবসায়ীর পক্ষেই ভালোভাবে ব্যবসা করা সম্ভব না। আর প্রতিমাসে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পারলে ব্যাংক তাকে জরিমানা হিসেবে অতিরিক্ত আরও টাকা দাবি করবে তখন ব্যবসায়ী আরো বড় বিপদে পড়বে।
আর যদি কোন কারণে ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় এবং ব্যবসায় লস করে, ঋণ এবং সুদের টাকা ফেরত দিতে গিয়ে তার জমি জামা বাড়িঘর এবং ব্যবসা পাতি সবই চলে যাবে। তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এবং যারা এখানে কর্মরত ছিল তারাও চাকরি হারাবে ফলের নতুন বেকারত্বের সৃষ্টি হবে।
এই সমস্যাগুলোর কারণে অনেক নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা সুদি ঋণের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী হয় না। ফলে তারা ব্যবসা শুরু করতে পারে না। দেশে যদি নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু না হয়, মানুষের জন্য নতুন নতুন কাজের জায়গা তৈরি হবে না। ফলে দিন দিন বেকারত্বের সমস্যা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে, আর এক সময় এটা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
অর্থনীতিতে সুদ না থাকলে, ঋণদাতাগণ মুনাফার অংশের ভিত্তিতে ব্যবসায় পুজিঁ যোগান দিবে। ফলে ছোট, বড় ও মাঝারি সকল ব্যবসায় একই শর্তে ঋণ পাবে; তা হলো মুনাফার অংশ। আর এইভাবে পুজিঁ পেলে অনেক নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু হবে এবং মানুষের বেকারত্বের সমস্যা দূর হবে।
৫. সুদ আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি করার সুযোগ করে দেয়।
সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় ঋণদাতা যাকে ঋণ দিচ্ছে, সে এই টাকাটা নিয়ে কি করবে সেই ব্যাপারে তাদের তেমন কোন গুরুত্ব থাকে না। কারণ তাদের মাস শেষে সুদ সহ আসল টাকাটা ফেরত পেলেই হল। সুদী ব্যবস্থায় সুদ প্রদানে রাজি হলেই ঋণ পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে সুদী ঋণপ্রাপ্তিকে আরও সহজ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র, ক্রেডিট কার্ড, ই-কার্ড, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণকে প্রত্যেক ভোক্তার হাতের মুঠোয় পৌছেঁ দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ আয় বুঝে ব্যয় করার নীতি বাক্য ভূলে গেছে এবং প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে ঋণ নিয়ে আয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয় করার দিকে ঝুকেঁ পড়ছে।
সুদ অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসিতামূলক ব্যয় বাড়িয়ে দেয়। একদিকে সহজলভ্য ঋণ অন্যদিকে নানারূপ আকর্ষণীয় ও উত্তেজনাকর বিজ্ঞাপন। এটি জনসাধারণকে কেবল অপ্রয়োজনীয় ব্যয় নয় বরং নৈতিকতা পরিপন্থী ব্যয়ের দিকেও ঠেলে দেয়।
বর্তমানে এমন অনেক মানুষ কে আপনি দেখতে পাবেন, যারা মাসে বেতন পায় ৩০ হাজার টাকা কিন্তু সে ক্রেডিট কার্ড এর মাধ্যমে সুদে ঋণ নিয়ে দেড় লক্ষ টাকা দামের iphone কিনে বসে আছে। অনেকে আবার ব্যাংক থেকে ছোট ছোট ঋণ নিয়ে টিভি, ফ্রিজ, এসি, অনেকে তো আবার বিলাসবহুল গাড়ি কিনে ফেলে। এই ধরনের জিনিস গুলা কোন উন্নয়নমূলক কাজে লাগে না। সুদের ভিত্তিতে ঋণ দানের পদ্ধতি যদি না থাকতো, তাহলে এই ধরনের অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমে যেত। কারণ এই ধরনের কাজে ঋণ দিয়ে ঋণদাতার তেমন কোন লাভ নেই। উপরোক্ত বিভিন্ন কারণে সাধারণ মানুষ ক্রমে সুদ ও ঋণের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধহয়ে পড়ছে।
৬. সুদ পাবার কারনে ঋণের সিকিউরিটি প্রদানর মত সম্পদ যাদে আছে, তারা বেশি ঋণ পায়। যাদের প্রয়োজন তারা পায় না।
সুদী ব্যবস্থায় ঋণদাতাগণ ব্যবসায়ীর দক্ষতা, উৎপাদনশীলতা ও লাভজনীনতা অপেক্ষা সুদসহ আসল ফেরত পাবার নিশ্চয়তার ওপরই অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে এবং প্রধানত এর ভিত্তিতেই ঋণ বরাদ্দ করে থাকে। ঋণদাতা জানে যে, ঋণের অর্থ বিনিয়োগ করে ঋণগ্রহীতার লাভ যদি খুব কম হয়, অথবা যদি লোকসান হয়, তাহলেও ঋণদাতার নির্ধারিত সুদ কমে যাওয়ার কোন আশংকা নেই। ঋণের সুদ সর্বাবস্থাতেই নির্ধারিত। এমতাবস্থায় কারবারের লাভ-লোকসানের প্রতি ঋণদাতার আগ্রহ না থাকাই স্বাভাবিক।
ঋণবহনযোগ্যতা বা ঋণের মর্টগেজ ও সিকিউরিটি প্রদানর মত সম্পদ যাদের যত বেশি আছে, তারা তত বেশি ঋণ পায়। একে বলা যায়, ‘তেল মাথায় তেল দেওয়া’। কারবার যত বৃহৎ হয় , ঋণ তত বেশি নেওয়ার সুযোগ পায় এবং কারবার আরও বড় হতে হতে আয়তন মিতব্যয়িতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। অপরদিকে ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো বড় প্রতিষ্ঠান অপেক্ষা অধিক দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার পরিচয় দিতে পারা সত্ত্বেও ঋণের অভাব শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মৃত্যুবরণে বাধ্য হয়। এভাবেই সুদ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানগুলোকে খতম করে দিয়ে বড়দের আরও বড় হবার সুযোগ করে দেয়। এতে সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; অর্থনীতি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছাতে পারে না।
অর্থনীতিতে সুদ না থাকলে, ঋণদাতাগণ মুনাফার অংশের ভিত্তিতে ব্যবসায় পুজিঁ যোগান দিবে। ফলে ছোট, বড় ও মাঝারি সকল ব্যবসায় একই শর্তে ঋণ পাবে; তা হলো মুনাফার অংশ। অতঃপর যে ব্যবসায় মুনাফার হর যত বেশি হবে, সে ব্যবসায় পুজিঁ সংগ্রহের যোগ্যতা তত অধিক হবে। এতে একদিকে তুলনামূকভাবে অধিক উৎপাদনশীল প্রকল্পসমূহ পজিঁ পাওয়ার ফলে সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন হবে সর্বোচ্চ। অন্যদিকে যাদের সম্পদ আছে কেবল তারাই ঋণ পাবে, আর যাদের সম্পদ নেই তারা ঋণ থেকে চিরদিন বঞ্চিত থাকবে এমন অবস্থাও সৃষ্টি হবে না, বরং ছোট প্রকল্প যদি সত্যিই বেশি লাভজনক হয়, তবে এর ঋণ পাবার পথে আর কোন বাধা থাকবে না। অন্যদিকে বড় কারবার যদি কম লাভজনক হয়, তাহলে কেবল বড়ত্বের কারণেই তা অধিক ঋণ পেয়ে আরও বড় হবার সুযোগ পাবে না। এভাবে প্রকল্পের লাভজনীনতা নিজেই সমাজের সর্বাচ্চ বিনিয়োগ ও উৎপাদন নিশ্চিত করবে এবং বৈষম্য হ্রাস করবে।
৭. সুদ বিদেশী দাতা দেশের স্বার্থ হাসিল করে।
বিশ্বের শিল্পোন্নত ধনী দেশগুলোই দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশকে ঋণ দেয়। এরা এমন কৌশল ও শর্ত আরোপ করে যাতে ঋণগ্রহীতা দেশ স্বাবলম্বী হওয়ার পরিবর্তে ক্রমে ঋণদাতাদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হতে বাধ্য হয় এবং দাতা দেশ যেন অধিক স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হয়। উদাহরণ স্বরূপ সমরস্ত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উন্নত দেশসমূহ প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরী করে। এসব পণ্যের বিক্রয় নিশ্চিত করা জরুরী। তাই কোন অনুন্নত দেশ অস্ত্র তৈরীতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক সে জন্য কোন ঋণ উন্নত দেশগুলো দেয় না, বরং তাদের বরাদ্দকৃত ঋণের এক বিরাট অংশ অস্ত্র আকারে দিয়ে থাকে।
অনেক সময় তারা যদি কোন প্রকল্পে ঋণ দেয়, তখন সেই প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং শ্রমিক অথবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকেই নিতে হবে এরকম শর্ত জুড়ে দেয়। যন্ত্রপাতির দাম বাজার মূল্যের থেকে বেশি দাম ধার্য করে। ফলে তাদের টাকা তাদের কাছেই ফিরে যায়। এই সুদ এবং ঋণ পরিশোধ করতে যেয়ে, প্রতিবছর দেশের বর্তমান সম্পদের একটা অংশ সুদ আকারে ধনী ঋণদাতা দেশের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে। ফলে দেশের সম্পদ হ্রাস পায় এবং ধনী দেশের সম্পদ আরও বৃদ্ধি পায়।
এ বিষয়ে আরও চমকপ্রদ উদাহরণ দেয়া যেতে পরে; বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। এদেশে জনসংখ্যা খুবই বেশি এবং অনেক মানুষই অশিক্ষিত ও অদক্ষ। এই বিরাট জনসমষ্টিকে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়নমুখী শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারলে এরা জনশক্তিতে পরিণত হতে পারে এবং এভাবে দেশটির পক্ষে স্বাবলম্বী হয়ে উঠা অসম্ভব নয়। কিন্তু উন্নত দেশগুলো এদেশের জনসংখ্যাকে দক্ষ করে তোলার জন্য ঋণ দেয় খুব কমই; বরং তারা কোটি কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় জনসংখ্যা হ্রাস করার জন্য যার এক বিরাট অংশ আবার তাদের দেশে উৎপাদিত জন্মনিয়ন্ত্রণ উপকরণ বিক্রয় করে বিরাট লাভ নিয়ে যায়। এমনিভাবে বৈদেশিক সুদী ঋণ আসলে, সেটা দাতা দেশসমূহের স্বার্থই হাসিল করে, গ্রহীতা দেশের উপকার এর দ্বারা খুব স্বল্পই হয়।
সুদ বিলোপ করা হলে সুদ ও আসল ফেরত দানের প্রতিশ্রুতিতে ঋণ পাওয়া যাবে না। এ অবস্থায় ধনী দেশ কর্তৃক দরিদ্র দেশকে আর্থিক সহযোগিতা দানের জন্য দুটো পথই কেবল খোলা থাকবে; প্রথমত, সরাসরি সাহায্য প্রদান করা এবং দ্বিতীয়ত, লাভ-ক্ষতির অংশীদারীর ভিত্তিতে দরিদ্র দেশের উৎপাদনশীল কাজে অংশগ্রহণ করা। এ অব্স্থায় অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার বা অপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসিতামূলক কাজে ব্যয় করার জন্য অর্থ পাওয়া যাবে না। ফলে বিদেশী দাতা দেশ, গরিব দেশগুলোকে ঋণের দায়ে আটকে রেখে তাদের স্বার্থ হাসিল করে নিতে পারবে না।
৮. সুদ ঋণ-দাসত্ব প্রথার জন্ম দেয়।
আপনি কি জানেন বাংলাদেশ বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যাংকের কাছে কত টাকা ঋণী? ২০২৩ সালের শেষ পর্যন্ত, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ছিল $১০০.৬ বিলিয়ন ডলার। ১০০ বিলিয়ন ডলার কত কোটি টাকা হয় জানেন? ক্যালকুলেটরে এই হিসাব ধরবেনা। এই ঋণ বাবদ প্রতি বছর কত ডলার সুদ হিসেবে দিতে হয় জানেন? প্রতি বছর বছর এই সংখ্যা শুধু বেরিয়ে যাচ্ছে। এক বছর আগে ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল $৯৬.৫ বিলিয়ন ডলার আর এক বছরের ব্যবধানে তা হয়ে গেল $১০০.৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে বাংলাদেশর মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ৩৬৫ ডলার বলে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। এর মানে হলো আমি এবং আপনি আমরা সবাই বিদেশের কাছে ৪০ হাজার টাকা করে ঋণী। আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশ কোনদিন এই ঋণ পরিশোধ করে এর থেকে বের হতে পারবে?
সুদ অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোকে চিরদিন ধনী দেশগুলোর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে বাধ্য করে। দরিদ্র দেশগুলো খুব কমই নিজের পায়ে দাড়ানোর শক্তি ও সাহস পায়। যে দেশ একবার সুদী ঋণের বোঝা ঘাড়ে তুলে নেয়, তার পক্ষে এ বোঝা নামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানো আর কখনও সম্ভব হয় না। নতুন উৎপাদনের জন্য না হলেও পুরাতন ঋণ পরিশোধের প্রয়োজনে তাকে ধনী দেশগুলোর কাছে যেতেই হয়। ফলে তাদের জুড়ে দেওয়া অনৈতিক, অমানবিক এবং ইসলামবিরোধী বিভিন্ন শর্ত মেনে নিতে হয়। এই বোঝা কাঁধে বয়ে চলতে হয় এবং যতই দিন যায় এ বোঝা ততই ভারী হতে থাকে। একজন ক্রীতদাস যেমন তার মালিকের কথার বাইরে যেতে পারেনা, আমরাও ঠিক তেমন পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে গেছে। এখনো যদি আমাদের ঘুম না ভাঙ্গে। তাহলে সেই দিন আর দূরে নাই যেদিন আমরা আল্লাহ এবং কোরআনের নামটাও মুখে নিতে পারবো না।
অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ না হয়েও পরিস্থিতির নাজুকতা উপলদ্ধি করতে অসুবিধা হয় না যে, প্রতিনিয়ত আমরা গোটা জাতিকে বিদেশী ঋণদাতাদের দাসত্বের অধীনে ঠেলে দিচ্ছি। প্রতিবছর আমরা বড় বড় অংকের ঋণ করছি। আর এভাবে আমাদের বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মের অনাগত ভবিষ্যৎ ঋণের কাছে বাঁধা (Mortgage) বাখছি। ধারণা করা হয় যে, বৈদেশিক ঋণ উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যবহৃত হয় এবং এসব দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশের ক্ষেত্রে এ ধারণা অসত্য প্রমাণিত হয়েছে। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ অর্থনীতিবদদের অনেকেই এ সত্য আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন।
প্রতি বছর তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশ গুলি, ঋণ পরিশোধের জন্য অধিক পারিমাণ অর্থ ফেরত প্রদান সত্ত্বেও মোট ঋণের বোঝা কি বিন্দুমাত্রও হ্রাস পেয়েছে? দুর্ভাগ্য যে তা হয়নি। বরং আরো বেড়েছে।
নিরপেক্ষ অনেক অর্থনীতিবদদের অভিমত হচ্ছে যে, তৃতীয় বিশ্বের ঋণের বিষয়টি কেবল আর্থিক বিষয় নয়, বরং এগুলো হচ্ছে রাজনৈতিক। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ও বিশ্ব ব্যাংকের (WB) ঋণ সর্বদাই কঠোর শর্ত সম্বলিত হয়ে থাকে। ফলে দেশগুলি এই ঋণ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। আর এই ঋণ প্রদান করতে ব্যর্থ হলে, পশ্চিমা দেশগুলো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর অব্যন্তরীণ ণীতিতে হস্তক্ষেপ করা শুরু করে।
খোদ বিশ্বব্যাংকের নিজের বক্তব্য অনুসারে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পসমূহের সাফল্যের হার ৫০%-এরও কম। যদিও এ হিসাবের ব্যাপারে বিশিষ্ট কয়েকজন অর্থনীতিবিদ ঘোরতর সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারমানে বিশ্বব্যাংক যে খাতে ঋণ প্রদান করে তার অর্ধেকের বেশি ব্যর্থ হয়। এই খাত গুলি ব্যর্থ হলে তারা কিন্তু ঋণ মাফ করে দেয় না। তারা ঠিকই সুদে এবং আসলে এই অর্থ ফেরত নেয়।
কোথাও দেখা যাচ্ছে ঋণের দ্বারা উন্নয়ন সাধিত হয়েছে ঠিক, কিন্তু তা ঋণ পরিশোধকে অসম্ভব প্রমাণিত করেছে। কোথাও অর্থায়নকৃত প্রকল্পটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট দেশটি বিরাট ঋণের তলায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। যা পরিশোধ করার আর কোন আশাই অবশিষ্ট নেই। কোথাও আবার পূর্ববর্তী ঋণ পরিশোধ করার জন্য বারবার নতুন ঋণ গ্রহণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
অনেক সমালোচক তৃতীয় বিশ্বের ঋণকে ভূমিদাস প্রথা সাথে তুলনা করেছেন। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ঋণ ব্যবস্থা সাথে ব্যক্তি পর্যায়ে ভূমিদাস প্রথার তুলনা করা যেতে পারে। ভূমিদাস প্রথা বা ঋণ দাসত্ব পদ্ধতিতে, ঋণদাতাদের কখনও এ উদ্দেশ্য থাকত না যে, ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে সম্পূর্ণ পাওনা ঋণ একেবারে উসূল করে ফেলবে। আবার ঋণগ্রহীতা খেতে না পেয়ে মরে যাক সেটাও তারা চাইত না। বরং তাদের আসল উদ্দেশ্য ছিল তাদের প্রদ্ত্ত ঋণের মধ্যমে মজুরদেরকে চিরকালের জন্য ঋণের দায়ে আবদ্ধ করে রাখা। আর তাদেরকে দিয়ে বিভিন্ন অন্যের্য ও অমানবিক কাজ করিয়ে নেয়া। যথাযথ অর্থে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এ ব্যবস্থা চলছে। বস্তুত এটা হচ্ছে আন্তর্জাতিক ঋণ-দাসত্ব প্রথা।
১৯৮৭ সালে ইন্সটিটিউট ফর আফ্রিকান অলটারনেটিভ-এর সম্মেলনে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বিলুপ্তি দাবী করা হয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের এখনো তাদের কার্যক্রম পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ এর মত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে নিরবে শোষণ করে যাচ্ছে।
তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহ বিদেশী ঋণ ছাড়া বেঁচে থাকতে পারে না। এই ধারণাটি ঠিক না। এই ধারণাটি ভ্রান্ত প্রমাণ করার জন্য উপরের তথ্য গুলি যথেষ্ট হওয়া উচিত। আসলে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে কারা লাভবান হচ্ছে? কানাডার একজন স্কলার, জ্যাকস বি. গেলিনাস বলেছেনঃ
“বিদেশী ঋণনির্ভর উন্নয়ন মডেল কোন একটি দেশকেও অর্থনৈতিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা থেকে বের করে আনায় নিজেকে সম্পূর্ণ অক্ষম বলে প্রমাণ করেছে। তবে এ মডেল তৃতীয় বিশ্বের কতিপয় সম্ভ্রান্ত লোকের জন্য অবিশ্বাস্য রকমের সম্পদ অর্জনের উৎসে পরিণত হয়েছে”
পরিশেষে আমরা এটা বুঝতে পারলাম যে, সুদের সাথে যারা লিপ্ত শুধু যে তারাই এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপারটা তা না। এমন মানুষ যারা সুদের সাথে কোনভাবেই লিপ্ত না তারাও এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই সুদ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, আর্থিক এবং সমগ্র দেশের এবং সমগ্র বিশ্বের সবার জন্য ক্ষতিকারক একটি জিনিস। অচিরেই আমরা যদি এটা বন্ধ করতে না পারি তাহলে এর ভয়াবহ পরিণতি সবাইকে ভোগ করতে হবে। যারা সুদি কারবার করে, সেটা হোক ছোট পরিসরে নিজ গ্রামে অথবা আন্তর্জাতিক বড় পরিসরে তারা সবাই সমাজের শত্রু, দেশের শত্রু আপনার এবং আমার শত্রু।
হতাশ হবেন না, আমরা চাইলে এই সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো ইনশাআল্লাহ। সুদের বিরুদ্ধে লিখতে থাকলে এই লেখা আর শেষ হবে না। কারণ সুদের ক্ষতি অগণিত। আর সুদের এই ভয়াবহ ক্ষতির কারণেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সুদকে হারাম করেছেন। সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে সুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আল্লাহ আপনাকে অস্ত্র হিসাবে জ্ঞান দান করেছেন। আমাদের সকলের উচিত নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী সুদ ভিত্তিক অর্থব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। সুদের লেনদেন থেকে নিজে বিরত হওয়া এবং আশেপাশের মানুষকে এবং পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনকে বিরত রাখা। মনে রাখবেন আপনি যদি একজন মানুষকে সুদ থেকে বাঁচাতে পারেন, এটাও আপনার অনেক বড় প্রাপ্তি। এর বিনিময়ে আল্লাহ আপনাকে অনেক বড় প্রতিদান দিবেন ইনশাআল্লাহ। ধৈর্যের সাথে লেখাটা পড়ার জন্য আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুক, জাযাকাল্লাহ খায়ের, আসসালামু আলাইকুম।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার একটি কালাম দিয়ে আজকের এই লেখা এখানেই শেষ করব “নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” – সূরাঃ আর-রাদ ১৩ঃ১১
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা ও ব্যাংক ব্যবস্থার ক্ষতিসমূহের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে “ব্যাংকব্যবস্থা ও টাকার গোপন রহস্য” বইটি পড়তে পারেন বইটির লেখক হলেন আব্দুল মোহাইমিন পাটোয়ারী।
আলোচ্য কোন বিষয় যদি আপনার বুঝতে অসুবিধা হয় অথবা এই ব্যাপারে আপনি আরো কিছু জানতে চান ও বুঝতে চান তাহলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। আমি খুশি মনে আপনাকে সেই বিষয়ে আরো তথ্য প্রদান করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আমার নাম ASIR, 01779414804 এটা আমার ফোন নাম্বার/WhatsApp Number।
“নিশ্চয় আল্লাহ কোন কওমের অবস্থা ততক্ষণ পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।” – সূরাঃ আর-রাদ ১৩ঃ১১