৪. হযরত হুদ আঃ এর পরিচয় ও বিশেষ ঘটনা

জন্মঃ হযরত হুদ (আঃ) আদ জাতির নিকট প্রেরিত হল। আদ ছিল হযরত নূহ (আঃ) এর চার অধস্তন পুরুষ। হযরত নূহ (আঃ)-এর পুত্র সাম। সামের পুত্র ইরাম। ইরামের পুত্র আউস। আউসের পুত্র আদ। সামের আর এক পুত্র ছিল তার নাম ছিল আবির। আবিরের পুত্রের নাম ছিল ছামুদ। আদ ও ছামুদের বংশাবলী ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করে। পরবর্তী সময় আদ ও ছামুদের নামে তাদের বংশাবলীর নাম করন করা হয়। কওমে আদ ও কওমে ছামুদ। পবিত্র কোরআনে আদ ও ছামুদ সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর নির্দেশাবলীর কথা উল্লেখ আছে।

বংশঃ আদ জাতি সম্পর্কে সম্পূর্ন একটি সূরা নাযিল হয়েছে যা সূরা হুদ নামে কুর’আনে আছে। আরেকটি সূরা যা সূরা আহকাফ সেখানেও আদ জাতির কথা উল্লেখ এসেছে। আল্লাহ তা’য়ালা হযরত হুদ (আঃ)-কে এ আদ জাতির হেদায়েতের জন্য তাদের নিকট নবী হিসেবে প্রেরন করেন। হযরত হুদ (আঃ) ছিলেন আদ বংশীয় লোক। আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনে একথা উল্লেখ করেন। তিনি কওমকে যখন হেদায়েতের দাওয়াত দিলেন তখন তারা নবীর কথা শুনে ঠাট্রা বিদ্রুপ আরম্ভ করে দিল।

বাসস্থানঃ কওমে আদ পারস্য উপসাগরের অববাহিকায় অবস্থিত ওমান থেকে লোহিত সাগরের প্রান্তে হাজরামাউত ও ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় কয়েকশত বছর আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তারা চার দেবতার পূজা অর্চনা করত। এক নম্বরের দেবতার নাম ছিল সাকীয়া। যাকে তারা বৃষ্টি দানকারী, ফসল দানকারী ও অর্থ দানকারী দেবতা বলে শ্রদ্ধা করত। দ্বিতীয় হল হাফিজা যাকে বিপদ মুক্তি, রোগ মুক্তি ও অমঙ্গল থেকে মুক্তি দানকারী বলে বিশ্বাস করত। তিন নম্বরে ছিল রাদিকা। এ দেবতাকে তারা অন্নদানকারী, শান্তি দানকারী ও পরকালের মুক্তি দানকারী দেবতা বলে সন্মান করত। চতুর্থ ছালীমা যাকে স্বাস্থ্য দানকারী, শক্তি দানকারী এবং যুদ্ধে বিজয় দানকারী বলে মনে করে তারা এ দেবতার পূজা করত।

বিশেষ ঘটনাঃ আল্লাহ যতগুলো জাতিকে গজব দিয়ে ধ্বংস করেছেন তার মধ্যে আদ জাতি অন্যতম।আদ জাতি ছিল দুর্ধর্ষ, শক্তিশালী এবং একই সাথে সম্পদশালী। তারা লম্বায় ছিল যে কারও চেয়ে বেশি, তাদের ছিল পেশীবহুল শরীর, তাদের হাড়ের গড়ন ছিল যে কারও চেয়ে শক্ত, এককথায় তারা ছিল অনন্য-তাদের সময়ে তাদের সাথে তুলনা করার মত আর কেও ছিলনা। কোরআনে তাদের স্বাতস্ত্র্য অতন্ত্য পরিষ্কার ভাষায় ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেছেঃ এমন দীর্ঘকায় ও শক্তিশালী জাতি ইতিপূর্বে পৃথিবীতে সৃজিত হয়নি। তারা ছিল ধ্বংসাত্মক মানষিকতার। তারা যাদের উপর আক্রমণ করত তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলত। তাদের ছিল বিশাল সৈন্যবাহিনী। এতই বিশাল যে সৈন্যবাহিনীর সামনের অংশ বিপক্ষদলকে যখন আক্রমণ করত পেছনের অংশ তখনও শহরের গেইট পার হতে পারত না। হযরত হুদ (আঃ) ছিলেন এই জাতির জন্য আল্লাহর প্রেরিত নবী।

আদ জাতি যখন হযরত হুদ (আঃ) কে অগ্রাহ্য করল তখন নবী তাদের জন্য বদদোয়া করলেন। আল্লাহ নবীর বদদোয়া কবুল করলেন। টানা তিন বছর কোন বৃষ্টি হল না। তাদের মাঠ-ঘাট, নদি-নালা, বিল সব শুকিয়ে গেল। পুরা আদ জাতির উপর নেমে এল দুর্ভিক্ষ। অনাহারে, অর্ধাহারে মানুষের দিন কাটতে লাগল। রাস্তা-ঘাটে মানুষের লাশ পরে থাকতে দেখা গেল। হাহকার শুরু হয়ে গেল। মানুষ অখাদ্য-কুখাদ্য খেয়ে জীবন ধারনের চেষ্টা করতে লাগল।

আদ জাতির মোট লোকসংখ্যা ছিল এক লক্ষ। মাত্র ৭০ জন মানুষ নবীর অনুসারী হয়েছিল। তারা নবীর কাছে আরজ করল- হে আল্লাহর নবী! দেশব্যাপী যে হারে দুর্ভিক্ষ হচ্ছে তাতে আমরা ও আমাদের আপনজনেরা কেও রেহাই পাবনা। অতএব, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, আল্লাহ যেন গজব উঠিয়ে নেয়। আমরা আবার আপ্রান চেষ্টা করব সবাইকে আল্লাহর পথে আনার। নবী দোয়া করলেন। বৃষ্টি হল। আবার ফসল উৎপাদিত হল। মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করল এবং স্বচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে লাগল। নবী আবার তাদের দাওয়াত দিলে তারা পরিস্কার বলে দেয় তারা কোনদিনই দাওয়াত কবুল করবেনা। বার বার নবী দাওয়াত পেশ করেন এবং আযাবের ভয় দেখান কিন্তু তারা ইমান আনলনা। বরং তারা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। নবী তাদের আচার আচরন দেখে আল্লাহর দরবারে আশ্রয় প্রার্থনা করলেন।

আল্লাহর তরফ থেকে জানিয়ে দেয়া হল, হে নবী আপনি আপনার ৭০ জন উম্মতকে নিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে যান এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিন। আপনি অতি শীঘ্রই তাদের উপর ঝড় ও বন্যার আযাব প্রেরন করছি। নবী তার কওমকে সতর্ক করলে তারা মোটেও কর্ণপাত করলনা। তারা বলল, হে হুদ (আ), তোমার আল্লাহ ঝড় ও বন্যার আযাব পাঠিয়ে আমাদের দুর্বল করতে পারবেনা। আমরা আমাদের কৌশল ঠিক করে রেখেছি। বরং তুমি যদি আমাদের আযাব থেকে রেহাই পেতে চাও তাহলে তোমার নব্যুয়তির দাবী ত্যাগ করে আমাদের মাঝে বসবাস কর, না হয় অতি সত্তর শহর ত্যাগ কর। আগামী দিন যেন তোমাদেরকে আর এই শহরে না দেখি।

নবী তার উম্মতদের নিয়ে শহর ত্যাগ করলেন, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ি এলাকায় পৌছেন এবং গুহায় ঢুকে আশ্রয় নেন। অতপর মহান আল্লাহ তায়ালা ফেরেস্তাদের আদেশ দিলেন ঝড়ের সামান্য নমুনা আদ জাতির উপর প্রেরন করার জন্য। আদ জাতি ঝড় দেখে খুশি হল, তারা ভাবল তাদের দেবতা তাদের উপর খুশি হয়ে বৃষ্টি দিচ্ছে, হযরত হুদ (আ) গোত্র ত্যাগ করায় তাদের দেবতা খুশি হয়ে তাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করছে। বৃষ্টির শুরুতে তারা তাদের গৃহে অবস্থান নিল কিন্তু ঝড়ের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে তারা পলায়ন করল এবং পাহাড়ে আশ্রয় নিল। টানা আট দিন ঝড়-ঝঞ্চা চলল। এমন ঝড় এই পৃথিবী আগে কখনও দেখেনি। তারা তাদের স্ত্রি-সন্তানদের মাঝখানে রেখে চারদিকে বেরিকেড দিল। কিন্তু ঝড় কাওকেই রেহাই দিল না। সুউচ্চ দালান-কোঠা, বাড়ি ঘর, মানুষের লাশ এখানে সেখানে পরে থাকল। পুরো জাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। বর্তমানে এই এলাকাটি আরব মানচিত্রে রবউলখালি বা জনশূন্য ভুখন্ড নামে পরিচিত। জনমানবহীন মরুপ্রান্তর আজও আদ জাতির নাফরমানির সাক্ষি হিসেবে পৃথিবীর বুকে বিদ্যমান।

মৃত্যুঃ হযরত হুদ (আঃ)-এর ইন্তেকালের পরে একশত বছর পর্যন্ত এ ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম ছিল। হযরত হুদ (আঃ) চারশত বছর জীবিত থেকে কওমকে হেদায়েত করেছেন। হযরত হুদ (আঃ)-এর ইন্তেকালের পরে কয়েক লক্ষ মানুষ তার জানাজা নামায আদায় করে পরম ভক্তিসহকারে তার দাফন কার্য সম্পন্ন করেন। হযরত হুদ (আঃ) নবুয়তীর দায়িত্ব পালনে যতখানি সফলতা লাভ করেছিলেন তা নজির বিহীন। বিনা যুদ্ধে ও বিনা রক্তপাতে এতখানি সফলতা অর্জন করা অন্য কোন নবীর জীবনে দেখা যায় নি।


ইসলামিক কুইজ: লেভেল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ৫০০ টি প্রশ্নের ইসলামিক কুইজ আয়োজন করেছি। এই কুইজে অংশগ্রহণ করে দেখে নিতে পারেন ইসলামের ব্যাপারে আপনার জ্ঞান কতটা। ইসলামিক কুইজে অংশগ্রহণ করতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি আপনি দেখতে পারেন। এখানে ইসলামিক এবং সমসাময়িক বিশ্বের বিভিন্ন কিছুর ব্যাপারে অনেক ভিডিও পেয়ে থাকবেন। আশা করি ভিডিওগুলো আপনাদের ভাল লাগবে। এখানে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top