১৮. হযরত দাউদ আঃ এর পরিচয় ও বিশেষ ঘটনা

পরিচয়ঃ বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র দু’জন। তাঁরা হ’লেন পিতা ও পুত্র হযরত দাউদ আঃ ও সুলায়মান (আঃ)। বর্তমান ফিলিস্তীন সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। সেকারনে আল্লাহ তার শেষনবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, 

‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি ছবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাঊদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/১৭)। দাঊদ হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হ’তে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়। উল্লেখ্য যে, হযরত দাঊদ আঃ সম্পর্কে কুরআনের ৯টি সূরায় ২৩টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ছিলেন শেষনবী (সা:)-এর আগমনের প্রায় দেড় হাজার  বছরের পূর্বেকার নবী দাঊদ কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়েই শক্তিশালী হননি, বরং তিনি জন্মগতভাবেই ছিলেন দৈহিকভাবে শক্তিশালী এবং একই সাথে ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান। নিম্নোক্ত ঘটনায় তা বর্ণিত হয়েছে।

জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্বঃ সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (মায়েদাহ ৫/২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’

(মায়েদাহ ৫/২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হ’লেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।

জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল (ﺷﻤﻮﻳﻞ) নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-

‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্তুত আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬)।

‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্তুত আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ ২/২৪৭-২৪৮)।

বিষয়টি এই যে, বনু ইস্রাঈলগণের নিকটে একটা সিন্দুক ছিল। যার মধ্যে তাদের নবী মূসা, হারূণ ও তাঁদের পরিবারের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী ছিল। তারা এটাকে খুবই বরকতময় মনে করত এবং যুদ্ধকালে একে সম্মুখে রাখত। একবার আমালেক্বাদের সাথে যুদ্ধের সময় বনু ইস্রাঈলগণ পরাজিত হ’লে আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূত উক্ত সিন্দুকটি নিয়ে যায়। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০,০০০ হাজার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। ইবনু কাছীর এই সংখ্যায় সন্দেহ পোষণ করে বলেন, ক্ষুদ্রায়তন ফিলিস্তীন ভূমিতে এই বিশাল সেনাদলের সংকুলান হওয়াটা অসম্ভব ব্যাপার।

অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ 

বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ: ‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক অাঁজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ ২/২৪৯)।

বস্তুত নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাজারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্তুবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। 

আল্লাহ বলেন ‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ ২/২৫০)।

জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। 

যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্তুত আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।

দাঊদ (আঃ)-এর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী

ছাগল পাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার: ইমাম বাগাভী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, ক্বাতাদাহ ও যুহরী থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা দু’জন লোক হযরত দাঊদের নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল ছাগপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্য ক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক ছাগপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার ছাগলপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও ছাগলের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে হযরত দাঊদ (আঃ) শস্যক্ষেতের মালিককে তার বিনষ্ট ফসলের বিনিময় মূল্য হিসাবে পুরা ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিতে বললেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলায়মানের সাথে দেখা হয়। তিনি মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। তিনি পিতা দাঊদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হ’ত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হ’ত’। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে সাময়িকভাবে দিয়ে দেওয়া হউক। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকার লাভ করুক। পক্ষান্তরে শস্যক্ষেতটি ছাগপালের মালিককে অর্পণ করা হউক। সে তাতে শস্য উৎপাদন করুক। অতঃপর শস্যক্ষেত্র যখন ছাগপালে বিনষ্ট করার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তা ক্ষেতের মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ছাগপাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়া হবে’। হযরত দাঊদ (আঃ) রায়টি অধিক উত্তম গণ্য করে সেটাকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,

‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৭৮-৭৯)।

বস্তুত উভয়ের রায় সঠিক ও সুধারণা প্রসূত ছিল। কিন্তু অধিক উত্তম বিবেচনায় হযরত দাঊদ স্বীয় পুত্রের দেওয়া পরামর্শকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। আর সেকারণেই আল্লাহ উভয়কে সমগুণে ভূষিত করে বলেছেন যে, ‘আমরা উভয়কে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করেছি’। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, বিচারক উত্তম মনে করলে তার পূর্বের রায় বাতিল করে নতুন রায় প্রদান করতে পারেন।

ইবাদত খানায় প্রবেশকারী বাদী-বিবাদীর বিচার: হযরত দাঊদ (আঃ) যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহ’লে তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হ’তেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হ’তেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতগুলিতে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আপনার কাছে কি সেই বাদী-বিবাদীর খবর পৌঁছেছে, যখন তারা পাঁচিল টপকিয়ে দাঊদের ইবাদতখানায় ঢুকে পড়েছিল’? (ছোয়াদ ২১) ‘যখন তারা দাঊদের কাছে অনুপ্রবেশ করল এবং দাঊদ তাদের থেকে ভীত হয়ে পড়ল, তখন তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা দু’জন বিবদমান পক্ষ। আমরা একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন, অবিচার করবেন না। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’ (২২)। ‘(বিষয়টি এই যে,) সে আমার ভাই। সে ৯৯টি দুম্বার মালিক আর আমি মাত্র একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে যে, এটি আমাকে দিয়ে দাও। সে আমার উপরে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে’ (২৩)। ‘দাঊদ বলল, সে তোমার দুম্বাটিকে নিজের দুম্বাগুলির সাথে যুক্ত করার দাবী করে তোমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকে একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করে থাকে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অবশ্য এরূপ লোকের সংখ্যা কম। (অত্র ঘটনায়) দাঊদ ধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ও আমার দিকে প্রণত হ’ল’ (২৪)। অতঃপর আমরা তাকে ক্ষমা করে দিলাম। নিশ্চয়ই তার জন্য আমাদের নিকটে রয়েছে নৈকট্য ও সুন্দর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (ছোয়াদ ৩৮/২১-২৫)।

উপরোক্ত পাঁচটি আয়াতে বা অন্য কোথাও এরূপ কোন ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি যে, সে পরীক্ষা কি ছিল, দাঊদ (আঃ) কি ভুল করেছিলেন, যে কারণে তিনি ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন এবং যা আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। ফলে সেই প্রাচীন যুগের কোন ঘটনার ব্যাখ্যা নবী ব্যতীত অন্য কারু পক্ষে এ যুগে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই ধারণা ও কল্পনার মাধ্যমে যেটাই বলা হবে, তাতে ভ্রান্তির আশংকা থেকেই যাবে। কিন্তু পথভ্রষ্ট ইহুদী পন্ডিতেরা তাদের স্বগোত্রীয় এই মর্যাদাবান নবীর উক্ত ঘটনাকে এমন নোংরাভাবে পেশ করেছে, যা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। বলা হয়েছে, দাঊদ (আঃ)-এর নাকি ৯৯ জন স্ত্রী ছিল। এ সত্ত্বেও তিনি তাঁর এক সৈন্যের স্ত্রীকে জোরপূর্বক অপহরণ করেন। অতঃপর উক্ত সৈনিককে হত্যা করে তার স্ত্রীকে বিয়ে করেন। এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে আল্লাহ দু’জন ফেরেশতাকে বাদী ও বিবাদীর বেশে পাঠিয়ে তাকে শিক্ষা দেন (নাঊযুবিল্লাহ)।

প্রশ্ন হ’তে পারে, তাহ’লে দাঊদ (আঃ)-এর ক্ষমা প্রার্থনা করার কারণ কি?

জবাব এই যে, দাঊদ (আঃ) আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটা সময় নির্দিষ্ট করেছিলেন। ঐ সময়টুকু তিনি কেবল ইবাদতেই রত থাকতেন। কিন্তু হঠাৎ পাঁচিল টপকিয়ে দু’জন অপরিচিত লোক ইবাদতখানায় প্রবেশ করায় তিনি ভড়কে যান। কিন্তু পরে তাদের বিষয়টি বুঝতে পারেন ও ফায়ছালা করে দেন। তাদের থেকে ভীত হওয়ার বিষয়টি যদিও কোন দোষের ব্যাপার ছিল না, তবুও এটাকে তিনি আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের খেলাফ মনে করে লজ্জিত হন এবং বুঝতে পারেন যে, এই ঘটনার দ্বারা আল্লাহ তাঁর তাওয়াক্কুলের পরীক্ষা নিলেন। দ্বিতীয়তঃ অধিক ইবাদতের কারণে প্রজাস্বার্থের ক্ষতি হচ্ছে মনে করে তিনি লজ্জিত হন এবং এজন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করেন ও সিজদায় লুটিয়ে পড়েন।

শনিবার ওয়ালাদের পরিণতি: বনু ইস্রাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাঊদ (আঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘মস্খ’ বা আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ মদীনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেন,

‘আর তোমরা তো তাদেরকে ভালভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’। ‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিলাম’ (বাক্বারাহ ২/৬৫-৬৬)।

তাফসীরে কুরতুবীতে বলা হয়েছে যে, ইহুদীরা প্রথমে গোপনে ও বিভিন্ন কৌশলে এবং পরে ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ দিনে মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তারা দু’দলে বিভক্ত হয়ে যায়। সৎ ও বিজ্ঞ লোকেরা একাজে বাধা দেন। অপরদল বাধা অমান্য করে মাছ ধরতে থাকে। ফলে প্রথম দলের লোকেরা শেষোক্তদের থেকে পৃথক হয়ে যান। তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। এমনকি তাদের বাসস্থানও পৃথক করে নেন। একদিন তারা অবাধ্যদের এলাকায় চরম নীরবতা লক্ষ্য করেন। অতঃপর তারা সেখানে পৌঁছে দেখলেন যে, সবাই বানর ও শূকরে পরিণত হয়ে গেছে। ক্বাতাদাহ বলেন যে, বৃদ্ধরা শূকরে এবং যুবকেরা বানরে পরিণত হয়েছিল। রূপান্তরিত বানরেরা নিজ নিজ আত্মীয়-স্বজনকে চিনতে পেরেছিল এবং তাদের কাছে গিয়ে অঝোর নয়নে অশ্রু বিসর্জন  করেছিল।

উক্ত বিষয়ে সূরা আ‘রাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যতঃ এরা ছিল শান্তিবাদী এবং অলস ও সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

‘আর যখন তাদের মধ্যকার একদল বলল, কেন আপনারা ঐ লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা তাদের আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? ঈমানদারগণ বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট ওযর পেশ করার জন্য এবং এজন্য যাতে ওরা সতর্ক হয়’। ‘অতঃপর তারা যখন উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা সেসব লোকদের মুক্তি দিলাম, যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত এবং পাকড়াও করলাম যালেমদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের পাপাচারের কারণে’ (আ‘রাফ ৭/১৬৪-৬৫)।

এতে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধকারীদের পক্ষাবলম্বন না করে নিরপেক্ষতা অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ যালেম ও ফাসেকদের সাথেই আল্লাহর গযবে ধ্বংস হবে। অতএব হকপন্থীদের জন্য জীবনের সর্বক্ষেত্রে আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা নেই।

ছহীহ মুসলিমে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাস‘ঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, একদা কয়েকজন ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে জিজ্ঞেস করলেন, হে রাসূল! এ যুগের বানর-শূকরগুলো কি সেই আকৃতি পরিবর্তিত ইহুদী সম্প্রদায়? তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা যখন কোন সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেন, কিংবা তাদের উপরে আকৃতি পরিবর্তনের আযাব নাযিল করেন, তখন তাদের বংশধারা থাকে না। আর বানর-শূকর পৃথিবীতে পূর্বেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তারা খায় না, পান করে না এবং তিন দিনের বেশী বাঁচে না।


ইসলামিক কুইজ: লেভেল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ৫০০ টি প্রশ্নের ইসলামিক কুইজ আয়োজন করেছি। এই কুইজে অংশগ্রহণ করে দেখে নিতে পারেন ইসলামের ব্যাপারে আপনার জ্ঞান কতটা। ইসলামিক কুইজে অংশগ্রহণ করতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন


আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি আপনি দেখতে পারেন। এখানে ইসলামিক এবং সমসাময়িক বিশ্বের বিভিন্ন কিছুর ব্যাপারে অনেক ভিডিও পেয়ে থাকবেন। আশা করি ভিডিওগুলো আপনাদের ভাল লাগবে। এখানে ক্লিক করুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top