জন্মঃ হযরত মুসা আঃ এর সময়কাল ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ত্রয়োদশ শতাব্দী। তখনকার সময়ে প্রাচীন মিশরের রাজধানী ছিল পেন্টাটিউক, নীল নদের তীরে ছিল এই নগরী। এই নগরীর শেষ প্রান্তে বসবাস করত বনি ইসরাইল বংশের লোকেরা। এই নগরীর সম্রাট ছিল এক ফেরাউন, নাম – রামেসিস। ফেরাউন ছিল বনি ইসরাইল বংশের প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন।
কারণ- একবার কতিপয় গনক গননা করে তাকে জানায় বনি ইসরাইল বংশের কোন এক সন্তান মিশরের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। এতে ফেরাউন বিচলিত হয়ে উঠে। সে তার রাজ্যে ঘোষনা দিয়ে দেয়- বনি ইসরাইল বংশে যত সন্তান জন্ম গ্রহন করবে সবাইকে যেন হত্যা করা হয়। তাই সেসময় ফেরাউনের গুপ্তচরেরা সন্তর্পণে ঘুরে বেড়াত। কেও জন্মগ্রহন করলেই তারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করত। হযরত মুসা আঃ এর জীবনী জানতে হলে তার জন্মের আগের ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঠিক এই সময়ই পিতা ইমরান আর মা ইউকাবাদের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্ৰহণ করেন শিশু মুসা (আঃ)। জন্মের পরপরই তাঁর মা খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। কোলের সন্তানকে বাঁচাতে বড় অস্থির হয়ে পড়েন । ধাত্রীকে কড়জোড় অনুরোধ করলেন সে যেন কাউকে কিচ্ছু না বলে। হযরত মুসা আঃ এর জত্যির্ময় চেহারা দেখে ধাত্রীর অন্তর প্রবল মমতায় ভরে উঠলো । সে এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবে না বলে মূসা আ এর মাকে নিশ্চিত করে ।
এভাবেই হযরত মুসা আঃ কে তাঁর মা তিন মাস গোপনে রাখলেন। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে লালন পালন করলেন। কিন্তু আর কতদিন? এই বুঝি ফেরাউনের রক্ষী বাহিনী এলো বলে। মায়ের মন সন্তানের নিরাপত্তার জন্য ক্রমশ ব্যাকুল হতে লাগলো। তখন আল্লাহ তায়ালা তাকে জানিয়ে দিলেন সে যেন একটি বাক্সে ভরে মুসা আঃ কে নদীতে ভাসিয়ে দেন । পবিত্র কুরআনে ব্যাপারটি এভাবে বর্ণিত হয়েছে, বাংলা অর্থঃ মূসার জননীর কাছে অহী পাঠালাম, শিশুটিকে স্তন্যদান কর। যখন তুমি এর সম্পর্কে কোন আশংকা করবে, তখন একে (নীল) দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও এবং ভয় করো না, দুঃখও করো না। নিশ্চয় আমি একে তোমার নিকট ফিরিয়ে দেব এবং একে একজন রসূল করব। (সূরা ক্বসাস , আয়াত ৭)
আল্লাহ তায়ালার উক্ত নির্দেশ অনুযায়ী তিনি কাঠের বাক্স বানিয়ে শিশু মুসা কে নদীতে ভাসিয়ে দেন। সেই কাঠের বাক্স ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদে গিয়ে ঠেকলো। কয়েকজন দাসী এসে তা তুলে নিয়ে ফেরাউন এবং তার স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুজাহিম রাঃ এর সামনে পেশ করলো।
হযরত আছিয়া বাক্সটা খোলার পর হযরত মুসা কে দেখে অতি মুগ্ধ হলেন। তিনি নিজের ছেলে হিসেবে রাখতে চাইলেন তাঁকে। কিন্তু বিপত্তি বাঁধাল ফেরাউন। সে এঁকে হত্যা করতে চাইলো। তার মনে প্রবল সন্দেহ হলো — এ শিশুটি বনী ইসরাইলের কেউ হবে। হতে পারে এই সে-ই। যার জন্য অসংখ্য শিশুকে সে হত্যা করেছে। কিন্তু হযরত আসিয়া বিনতে মুজাহিম রাঃ যুক্তি দিয়ে বললেন, ‘সে হয়ত আমাদের চক্ষের শীতলতা হবে। তাঁকে হত্যা করবেন না। আমরা তাকে আমাদের মত করে গড়ে নিব।’ ফেরাউন তার কথা মেনে নিল।
পবিত্র কুরআনের বর্ণনায়, ফিরআউনের স্ত্রী বলল, ‘এ শিশু আমার এবং তোমার নয়ন-প্রীতিকর। তোমরা একে হত্যা করো না। সম্ভবতঃ সে আমাদের উপকারে আসবে অথবা আমরা তাকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করব।’ প্রকৃতপক্ষে ওরা এর পরিণাম বুঝতে পারেনি।(সূরা ক্বসাস , আয়াত ৯)
শৈশবকালঃ হযরত মুসা আঃ কে দুধপান করানো নিয়ে বেশ জটিলতায় পড়লেন আসিয়া রাঃ। ক’জন ধাত্রীকে আনা হলো অথচ সে কারো বুকেই মুখ লাগালো না। এসব ঘটনা প্রত্যক্ষ দেখছিলেন মূসা আঃ এর বোন। সে বলল , ‘আমি একজন ধাত্রীর সন্ধান দিতে পারি। সে অতি যত্নের সাথে তাকে লালন করবে এবং আমি আশাবাদী সে তাঁর দুধ পান করবে।’ এই ঘটনাটি ইবনে আব্বাস রা এভাবে বর্ণনা করেন, মূসা আঃ এর বোনের কাছ থেকে এ কথা শুনে ফেরাউনের লোকেদের মনে সন্দেহ জাগলো — এই মেয়েটি বোধহয় তাঁর মা বাবার খোঁজ জানে।
তখন তাকে প্রশ্ন করা হলো, তুমি জানো কি করে তোমার নির্ধারিত ধাত্রীই তাঁর উপযুক্ত হবে? তখন মরিয়ম বললেন , আমি চাই বাদশাহ খুশী হোক এবং আমরা উত্তম সম্মানী পাই। একথাই তাদের সন্দেহ নিরসন হলো। মূসা আ তাঁর মায়ের কোলেই প্রাসাদে লালিত পালিত হলেন। আল্লাহ তাঁর মায়ের অন্তর প্রশান্ত করে দিলেন।
মুখে জড়তা তৈরী হলো যেভাবেঃ বিপত্তি বাঁধল কিছুদিন যাওয়ার পর। ফেরাউন মুসা আঃ কে কোলে নিলেন। তখন মূসা আঃ তার গালে প্রচণ্ড জোরে চড় বসালেন। কোন কোন বর্ণনায় আছে, তিনি ছড়ি দিয়ে খেলছিলেন। ফেরাউন কাছে যেতেই তিনি মাথায় আঘাত করে বসলেন। এই ঘটনায় ফেরাউন বেশ চটে যায়। সে মূসা আঃ কে হত্যা করতে চাইলো। তবে আসিয়া রাঃ বুঝালেন, এটা নিতান্তই শিশুসুলভ আচরণ । আপনি তাকে পরিক্ষা করে দেখতে পারেন।
আসিয়া রাঃ এর কথামত পরীক্ষার আয়োজন করা হলো । এক পাত্রে মণিমুক্তা আরেকপাত্রে আগুনের অঙ্গার । মূসা আঃ কে ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি মণিমুক্তার দিকে গেলেও জিবরাঈল আঃ তাঁকে অঙ্গারের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। তিনি অঙ্গার হাতে স্পর্শ করে মুখে দিতেই মুখ পুড়ে গেল। সেই থেকে শুরু হলো তাঁর মুখের জড়তা। অধিকাংশ তাফসিরবিদগণ এভাবেই বর্ণনা করেছেন।
হযরত হারুন আঃ এর জন্য নবুয়তের সুপারিশঃ হযরত মুসা আঃ তাঁর জীবনের দীর্ঘ সময় ফেরাউনের প্রাসাদে কাটিয়েছেন। শৈশবে মুখ পুড়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মুখে জড়তা সৃষ্টি হয়। অথচ নবুয়তের কাজ আঞ্জাম দেওয়ার জন্য বিশুদ্ধভাষী হওয়া জরুরী। তাই তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানালেন, ‘হে আমার পালনকর্তা আমার বক্ষ প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন এবং আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন। যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। এবং আমার পরিবারবর্গের মধ্য থেকে আমার একজন সাহায্যকারী করে দিন। আমার ভাই হারুনকে। তার মাধ্যমে আমার কোমর মজবুত করুন এবং তাকে আমার কাজে অংশীদার করুন । যাতে আমরা বেশী করে আপনার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা করতে পারি এবং বেশী পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি। আপনি তো আমাদের অবস্থা সবই দেখছেন।’ (সূরা ত্বহা , আয়াত ২৬-৩৬)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাঁর প্রার্থনা কবুল করলেন। এবং অতিসত্বর মিশরে যাওয়ার আদেশ দিলেন। সেইসাথে মূসা আঃ কে স্বরণ করিয়ে দিলেন তাঁর প্রতি শৈশবের অনূগ্ৰহের কথা। সে কথা কুরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে , আল্লাহ বললেনঃ হে মূসা, তুমি যা চেয়েছ তা তোমাকে দেয়া হল। আমি তোমার প্রতি আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম। যখন আমি তোমার মাতাকে নির্দেশ দিয়েছিলাম , তুমি (মূসাকে) সিন্দুকে রাখ, অতঃপর তা দরিয়ায় ভাসিয়ে দাও, অতঃপর দরিয়া তাকে তীরে ঠেলে দেবে। তাকে আমার শক্র ও তার শক্র উঠিয়ে নেবে। আমি তোমার প্রতি মহব্বত সঞ্চারিত করেছিলাম আমার নিজের পক্ষ থেকে, যাতে তুমি আমার দৃষ্টির সামনে প্রতি পালিত হও। (সূরা ত্বহা , আয়াত ৩৭-৪০)
মৃত্যুঃ মুসা আঃ এর মৃত্য হয়েছিল ফিলিস্তিনে। তাঁর মৃত্যুর জন্য যখন মালাকুল মাওত আসল তখন তাকে মুসা আঃ চপেটাঘাত করেন। মালাকুল মাওত আল্লাহর কাছে গিয়ে বলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাকে এমন এক বান্দার কাছে পাঠিয়েছেন যিনি মৃত্যু চান না।’ আল্লাহ বললেন , তাঁকে একটি ষাঁড়ের পিঠে হাত রাখতে বলো। তাঁর হাতের নিচে যতগুলো পশম পড়বে তাঁকে ততগুলো বছর হায়াত দেওয়া হবে । মুসা আঃ বললেন, আল্লাহ , তারপর কী হবে? আল্লাহ বললেন, তারপর মৃত্যু। মুসা আঃ এ কথা শুনে বললেন , তাহলে সে মৃত্যু এখনই হোক। এরপর তিনি হাতে একটি পাথর নিয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে ঢিল ছুঁড়লেন। পাথরটি যেখানে গেল সেখানে তাঁকে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করলেন। অতঃপর সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করলেন। তার হায়াত ছিল দীর্ঘ ১২০ বছর। দীর্ঘ আয়ুষ্কাল তিনি তার গোত্র বনি ইসরাইলকে পথ প্রদর্শন করেছেন। এর মাঝে ৪০ বছর তিনি তার গোত্রকে নিয়ে এসেছেন মিশর থেকে ফিলিস্তিনে। সারা জীবন তিনি কোন সুখভোগ করেননি। তিনি তার জীবন কাটিয়েছেন তার গোত্র বনি ইসরাইলের জন্য, তাদের নানা বিপদ আপদে তিনি অকুন্ঠভাবে সহযোগিতা করেছেন।
ইসলামিক কুইজ: লেভেল ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ৫০০ টি প্রশ্নের ইসলামিক কুইজ আয়োজন করেছি। এই কুইজে অংশগ্রহণ করে দেখে নিতে পারেন ইসলামের ব্যাপারে আপনার জ্ঞান কতটা। ইসলামিক কুইজে অংশগ্রহণ করতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি আপনি দেখতে পারেন। এখানে ইসলামিক এবং সমসাময়িক বিশ্বের বিভিন্ন কিছুর ব্যাপারে অনেক ভিডিও পেয়ে থাকবেন। আশা করি ভিডিওগুলো আপনাদের ভাল লাগবে। এখানে ক্লিক করুন